আমাদের অতি পরিচিত একটি ঔষধি গুণাগুণ সমৃদ্ধ গাছ হচ্ছে নিম। এটি একটি বহুবর্ষজীবী ও চিরহরিৎ জাতীয় বৃক্ষ। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন নিম গাছের সবকিছুই ব্যবহার করা যায়। নিম পাতার উপকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না তবে কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে।
প্রাচীন ভারতীয় উপহাদেশে গত ৫ হাজার বছরের আগে থেকে ঔষধি গাছ হিসেবে এটির ব্যবহার হয়ে আসছে। এতে রয়েছে ১৩০টি ঔষধি গুণাগুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টিতে নিম গাছের গুরুত্ব অত্যধিক জরুরি। সেকারণে তারা একে একুশ শতকের বৃক্ষ বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
নিম পাতার উপকারিতা
ভালো স্বাস্থ্য রক্ষায় নিম পাতার উপকারিতা অনস্বীকার্য। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সুন্দর নিরোগ জীবন যাপনে এটির জুড়ি মেলা আসলেই ভার। নীচে নিম পাতার বহুমুখী উপকারিতা তুলে ধরা হলো:
ক) রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:
নিমপাতা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এটির মধ্যে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিেন্ট উপাদান থাকে। প্রতিদিন কয়েকটি নিমপাতা গুঁড়া করে এক গ্লাস পানির সাথে পান করলে রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
খ) ওজন কমায়:
নিমের ফুলে ওজন কমানোর অসাধারণ সক্ষমতা রয়েছে। এটি শরীরে মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত চর্বি ভাঙ্গতে সাহায্য করে। বিশেষ করে তলপেটের চর্বি কমাতে এটি বিশেষভাবে উপকারী। এক মুঠো নিম ফুল চূর্ণের সাথে ১ চামুচ মধু এবং আধা চামুচ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এই মিশ্রণটি পান করলে ওজন কমবে।
গ) ভাইরাস প্রতিরোধ:
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে ভাইরাস রোগ প্রতিরোধে নিমের ব্যবহার হয়ে এসেছে। আধুনিক চিকিৎসার উন্নতি হওয়ার আগে চিকেন পক্স, হাম ও অন্য চর্মরোগ হলে নিমপাতা বাটা লাগানো হতো। নিমপাতা পানিতে সিদ্ধ করে সে পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বকের জ্বালাপোড়া ও চুলকানি দূর হয়।
ঘ) অ্যালার্জি দূরে রাখে:
অ্যালার্জি সমস্যা দূর করতে প্রতিদিন নিম পাতা ফুটিয়ে গোসল করুন। এছাড়াও কাঁচা হলুদের সাথে নিম পাতা বেঁটে শরীরে লাগাতে পারেন। এতে অ্যালার্জি কমবে।
ঙ) চোখে চুলকানি:
আরো দেখুন: কচু শাকের উপকারিতা
চোখ চুলকালে নিমপাতা পানিতে দশ মিনিট সিদ্ধ করে ঠান্ডা করে নিন। এবার সেই পানি চোখে ঝাপটা দিন, এতে আরাম পাবেন।
চ) ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকরী:
নিমপাতা সেদ্ধ পানি ঠাণ্ডা করে স্প্রে করা যায় এমন বোতলে রেখে দিন। এরপর নিয়মিত এটি ঘরে স্প্রে করুন এতে মশার উপদ্রব কমে যাবে। এতে ম্যালেরিয়া হওয়ার ঝুঁকিও হ্রাস পাবে।
ছ) পোকা-মাকড়ের কামড়:
পোকা মাকড় কামড় দেওয়া জায়গায় নিম গাছের মূলের ছাল অথবা পাতা বেটে লাগালে ব্যথা কমে আসবে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যেনো পোকা-মাকড় বিষাক্ত না হয়। এমন হলে অনতিবিলম্বে চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হতে হবে।
জ) খুশকি দূর করে:
খুশকি নিরাযয়ের ওষুধের মধ্যে নিম পাতা অন্যতম। নিমে থাকা ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক নাশক উপাদান খুশকি দূর করতে সহায়তা করে। মাথার তালুর শুষ্কতা ও চুলকানি দূর করতেও এটির সক্ষমতা রয়েছে।
খুশকি দূর করতে চার কাপ পানিতে এক মুঠো সমান নিম পাতা নিয়ে গরম করতে হবে যতক্ষণ না পানিটা সবুজ রঙ ধারণ করে। এবার পানিটা ঠান্ডা করে নিন এবং শ্যাম্পু করার পর তা দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে ২-৩ বার এটি ব্যবহার করলে তা কন্ডিশনারের মতো কাজ করবে আর খুশকি দূর করবে।
ঝ) ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ করে:
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে নিম দারুণভাবে কাজ করে। নিমপাতা রক্তের শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত প্রাতরাশে ৫টি গোলমরিচ ও ১০টি নিম পাতা বেটে খেলে তা ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি রক্তনালীকেও প্রসারিত করে রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থাকে উন্নত করে।
ঞ) উকুন দূর করে:
নিমের ব্যবহারে উকুন দূর হয়। সপ্তাহে ৩ বার ২ মাস নিমের পেস্ট বানিয়ে মাথায় মাখুন, এরপর মাথায় শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন এবং উকুনের চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ান। এতে উকুন দূর হবে।
ট) দাঁতের রোগ নিরাময়ে:
নিমপাতা, ছালের গুড়া অথবা ডাল দিয়ে নিয়মিত দাঁত মাজলে দাঁত মজবুত হয়। এতে বিভিন্ন ধরনের দন্তরোগও নিরাময় হয়।
ঠ) বাত নিরাময়ে:
নিমের তেলের ম্যাসাজ বাতের ব্যথা অনেক উপকারী। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় বাতের ব্যথা কমাতে নিমপাতা, নিমের বীজ ও বাকল ব্যবহৃত হতো। এখনো এদের বাতের ব্যথায় ওষুধ হিসেবে কাজে লাগানো হয়।
ড) চর্মরোগ নিরাময় করে:
নিমপাতা ব্রণ, ফোঁড়া, অ্যাকজিমাসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ সমস্যায় বেশ উপকারে আসে। ত্বকের যেসকল স্থানে এই ধরনের সমস্যা হয় সেখানে নিমপাতা বেটে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
আরো দেখুন: ব্রকলির উপকারিতা
নিম পাতার রসের উপকারিতা
নিম পাতার রস একাধিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজে লাগে। নীচে নিম পাতার রসের বেশকিছু উপকারিতা তুলে ধরা হলো:-
১) কৃমিনাশক-
কৃমি নির্মূল করতে নিম পাতার জুড়ি মেলানো ভার। শিশুরাই এতে বেশি আক্রান্ত হয়। নিমপাতার রস কৃমি দূর করতে সহায়তা করে। এছাড়া ৫০ মি.লি. পরিমাণ নিমের মূল ছালের গুঁড়া দিনে ৩ বার সামান্য গরম পানি দিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
২) চুলের ঔজ্জ্বল্য বাড়ায়-
চুল উজ্জ্বল, সুন্দর ও আকর্ষণীয় করতে নিমপাতার রস খুবই উপকারী। এমনকি খুশকি দূরীকরণেও এটি উপযোগী। প্রতি সপ্তাহে একদিন নিমপাতা ভালোভাবে বেটে চুলে লাগিয়ে ঘণ্টাখানেক রাখতে হবে। এরপর ঘন্টাখানেক পর ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। এতে চুলের উপকার হবে।
৩) রক্ত পরিষ্কার রাখে-
নিমপাতার রস রক্ত পরিষ্কার করে। এটি রক্তের দূষিত পদার্থ সমূহকে শরীর থেকে বের করে দেয়। এটি একইসাথে রক্ত প্রবাহের গতি ঠিক রেখে হৃদযন্ত্রকেও স্বাভাবিক রাখে।
৪) জন্ডিস প্রতিরোধ করে-
নিয়মিত সকালে খালি পেটে নিম পাতার রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে তা জন্ডিস নিরাময়ে সাহায্য করে। ২৫-৩০ ফোঁটা নিমপাতার রস এক সপ্তাহ পর্যন্ত খেলে জন্ডিস রেখে রক্ষা পাওয়া যায়।
নিম পাতার বড়ির উপকারিতা
কবিরাজি, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিম পাতার বড়ির প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। ঘরে বসেই নিম পাতার বড়ি তৈরি করা যায়। তবে সময় না মেলাতে পারলে বাজার থেকেও কিনে আনতে পারেন। নীচে এর উপকারসমূহ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো:
- কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা নিরসনে নিমপাতার বড়ি দারুণভাবে কার্যকরী।
- এটিতে বসন্ত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রয়েছে।
- নিম পাতার বড়ি খেলে পেপটিক ও ডিওডেনাল আলসার উপশম হয়। আলসার থেকে ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং, পরোক্ষভাবে এটি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
কীভাবে তৈরি করবেন নিমপাতার বড়ি
বাড়িতে সহজেই তৈরি করে নিতে পারেন নিমপাতার বড়ি। এটি তৈরি করতে যা যা প্রয়োজন তা হচ্ছে:-
- নিম পাতা
- ২৫০ গ্রাম কাঁচা হলুদ
- পানি
কার্যপ্রণালী:-
প্রথমে নিমের পাতা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। এবার কাঁচা হলুদের খোসা কেটে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এবার নিমপাতা ও হলুদকে আলাদা আলাদা বা একত্রে ভালোভাবে পিষে নিন। এবার এই মিশ্রণ থেকে ছোট ছোট অংশ দুই হাতের তালুতে নিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করুন।
তবে খুব বেশী যেন ছোট না হয়। কেননা রোদে দিলে তা আরো ছোট হয়ে আসবে। এবার সবগুলো বড়িকে রোদ্রে শুকিয়ে নিতে হবে। মাঝে মাঝে বড়িগুলোকে উপর নীচে করে দিতে হবে। এভাবে ৪-৫ দিন শুকালে বড়িগুলো খাবার উপযোগী হয়ে উঠবে।
নিমপাতার ক্ষতিকর দিক:
একজন ব্যক্তি টানা কতদিন কয়টি নিমপাতা গ্রহণ করবে সেটা একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ঠিক করা উচিৎ। যদিও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এতো তীব্র নয় তবুও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
- খালি পেটে বেশিদিন এটি খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
- কারোর যদি এটি খাওয়ার পর বমি বমি ভাব, ডায়েরিয়া, মাথাব্যথার মতো সমস্যা হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ এটি খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ।
- নিম মাঝে মাঝে বন্ধ্যাত্বতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই যারা সন্তান নিতে চাচ্ছেন তারা এটি থেকে দূরে থাকুন।
- যেকোনো প্রকার অপারেশনের দুই সপ্তাহ আগে থেকে নিমের ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে।
- গর্ভবতী মায়েদের জন্য নিমপাতা উপযোগী নয়। এটি গর্ভপাতের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
- যাদের নিম্নরক্তচাপের সমস্যা রয়েছে, তারা এটি খাওয়া থেকে দূরে থাকুন।
- দিনে সর্বোচ্চ দুটি নিমপাতা খাওয়া উচিৎ। এর অতিরিক্ত ব্যবহার উপকারের চেয়ে বেশি অপকার করবে।
পরিশেষে-
নিম গাছের ছাল থেকে শুরু করে ডাল সবকিছুই কাজে লাগানো যায়। আবার নিম গাছের এতো রক্ষণাবেক্ষণেরও প্রয়োজন হয় না। তাই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে নিজেদের প্রয়োজন অনুধাবন করে নিমপাতা ব্যবহার করুন।